ভয় -->
মধুপুরের বিখ্যাত
ডাকাতইদ্রিস আলি কে খুন
করা হয়েছিল সন্ধাবেলা ।
মাথার পেছনে প্রথমে শক্ত
কিছু দিয়ে আঘাত করেঅজ্ঞান করা হয় , তারপর গলায়
রশি পেচিয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়
মধুপুর মসজিদের পাশের আম
গাছটায় । ফজরেরনামাজ
পড়তে এসে গ্রামের সব
চেয়ে বৃদ্ধ লালু শেখ যখন আমগাছ তলায় কিছু
একটা দেখে অজ্ঞান হয়ে যায় ,
খবরটা তখনও কেউ জানেনি ।
বোবা জামাল
শীতে কাপতে কাপতে খেজুর
গাছ থেকে রসের হাড়িটা নিয়ে যখন নামছিল ,
হঠাৎ করেই তার চোখ গেল
আমগাছটার দিকে , আধহাত
লম্বা জিহ্বা বের করে ইদ্রিস
আলি তখন তার দিকেই
চেয়ে আছে । বোবা জ়ামালের হাত থেকে রসের
হাড়িটা পড়ে গেল , গাছ
থেকে এলোপাথাড়ি নামতে গিয়ে দুই
পা কেটে গেল , সেখান
থেকে দরদর করে রক্ত
বেরুতে লাগল । গাছ থেকে নেমেই সে বিকট
চিৎকার করতে করতে গ্রামের
দিকে ছুটল । যে খবর
সারারাতে কেউ জানেনি ,
পরবর্তী আধ ঘন্টায় গ্রামের
সকল মানুষ তা জেনে গেল । বোবা জামাল তাদের
মুখে কিছুই বলতে পারে নি,
কিন্তু বারবার আমগাছ তলার
দিকে আঙ্গুল উচিয়ে কিছু
একটা দেখানোর
চেষ্টা করছিল , লোকজন কিছু একটা আন্দাজ
করে আমগাছতলায়
এসে থমকে যায় । ইদ্রিস
আলীর বের করা জিভে তখন
মাছি ভন ভন করছে ,সারা মুখ
কালো হয়ে আছে রক্তে , কোটর থেকে চোখটা যেন বের
হয়ে আসতে চাচ্ছে । জীবিত
ইদ্রিস আলীর সাথে এ মৃত
ইদ্রিস আলীর কোনই মিল নেই
। এ ভয়ংকর মৃত্যু অনেকেই সহ্য
করতে না পেরে পালিয়ে যায় আমগাছতলা থেকে । লাশের
নিচে তখনো লালু শেখ
পড়ে আছে , বিড়বিড় করে কিছু
একটা বলার চেষ্টা করছে ।
কেউ তাকে তুলতে যাচ্ছেনা ,
সবাই তাকিয়ে আছে লাশের দিকে , এ যেন এক মায়া ! কুহক !
। ক্রমে মানুষ ভীড়
করতে লাগল এ আমগাছতলায় ।
যে আমগাছতলা এতকাল ছিল
নিরব নির্জন , সকাল দশটার
মাঝেই সে আমগাছতলা হয়ে গেল
লোকে লোকারণ্য । দশটার কিছু
পরে সাবইন্সপেকটর কাওসার
আহমেদ গ্রামের চেয়ারম্যান
জলিল হোসেনের
বাড়িতে এসে হাক ছাড়ল, --জলিল সাব বাড়িতে আছেন
নি?
জলিল হোসেন তখন
উঠোনে পিড়িতে বসে নাপিত
দিয়ে চুল কাটাচ্ছিলেন ।
বিরক্ত স্বরে বললেন --আছি । কেডা?
--আমি কাওসার ।
--ও , সাবইন্সপেকটর সাব ।
আসেন ভিতরে আসেন ।
কাওসার বাড়ির ভিতরে ঢুকেই
চেয়্যারম্যানকে বলল, --তা , লাশের কি করবেন,কিছু
ঠিক করলেন ?
--না , এহনো ঠিক করি নাই ।
আপনে কি কন , কি করা যায়?
--আমি কই ,লাশ কবর
দিয়া ফালান । এইটা নিয়া ঝামেলা করার
ইচ্ছা করতাছেনা ।
--ঠিক আছে , ইস্নপেকটর সাব
। তাই করতাছি। আপনে কিন্তু
চা খাইয়া যাইয়েন ।
সাবইন্সপেকটর কাওসার চাখেয়ে চলে গেলেন ।
লাশটা তখনো গাছে ঝুলছে ।
কেউ লাশ
নামাতে যাচ্ছে না । এ মৃত্যু
স্বাভাবিকনয় । মানুষ সকল
অস্বাভাবিকতাকে ভয় পায় । এটা মানুষের এক সহজাত ধর্ম
। এখানে কোন অতিপ্রাকৃতিক
ঘটনা ঘটেনি , কিন্তু ইদ্রিস
আলীর মৃত্যু সব অতিপ্রাকৃতিক
ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে ।
এখানে সবাই মৌন । কিছু একটা দেখার প্রতীক্ষায়
তাকিয়ে আছে সবাই ।
হঠাৎ মসজিদের ইমাম সিরাজ
মিয়া কোথা হতে উদয়হয়ে চেচিয়ে উঠল ,
--ওই মিয়ারা লাশ
কি গাছেইপচব নাকি ? আসেন , লাশ নামাইতে অইব ।
বলেই সিরাজ
মিয়া লুঙ্গি মালকোচা মেরে তরতরিয়ে গাছে উঠে গেল
। লাশের নিচে দুইজন চট
বিছিয়ে ধরল । সিরাজ
মিয়া উপর থেকে রশি কেটে দিতেই ধপ
করে লাশটা পড়ল চটে । তীব্র
মানুষ পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল
এলাকাজুড়ে ।
বিকেল হওয়ার আগেই,
জানাজা না পড়িয়েই ইদ্রিস আলীকে পুঁতে ফেলা হল গ্রামের
দক্ষিণ দিকের পোড়াবাড়ির
পাশের জমিতে ।
অপঘাতে মরা লাশ ।
কি না কি হয়, এই
ভয়ে গ্রামের সকল ছেলেবুড়োকেনিষেধ করা হল
আগামী সাতদিন
যাতে এদিকে কেউ না আসে
।।
পরদিন সকালে লাল্টুদের
মুদি দোকানে বসে সিরাজ মিয়া চা খেতে খেতে আচমকাবলে উঠল
--ও লাল্টুর বাপ ।
কালকে রাইতে তো মনে হয়
ইদ্রিসরে দেখলাম ।
--কি কন ইমাম সাব!
ইদ্রিসরে ? --হ, ফজরের নামাজ পড়ানোর
জন্য ওজু করতাছিলাম ।
আন্ধাইর তহনো যায় নাই ।
হঠাৎ চোখ গেলগা আম গাছটার
দিকে ।
আন্ধাইরে ঠিকমতো কিছু দেহা যায়না । তবুও ছায়ার
মতো দেখলামআমগাছতলায়
আন্ধইরে কিছুএকটা বইয়া আছে ।
আমি পাত্তা না দিয়া ওজু
করতেলাগলাম । আন্ধাইরে কত
কিছুই দেহা যায় । সবকিছুকে পাত্তা দিতে নাই ।
কিন্তু কিছুক্ষণ
পরে হুনলাম ,খুবই
অদ্ভুতস্বরে কেডা জানি কানতাছে ।
আর কান্নার শব্দটা আইতাছিল
ওই আমগাছের তল থেইকা । তহন পাইলাম ভয় ।
তাড়াতাড়ি ওজু শেষ
কইরা মারলাম দৌড়।
এ
ঘটনা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে বেশী দেরি হলনা ।
আমগাছতলাটা সকলের কাছে হয়ে গেল ভীতিকর এক
জায়গা ।
এর একমাস পর ফজরের
নামাজপড়তে এসে গ্রামের
লোকজন,ইমাম সিরাজ
মিয়াকে মসজিদে না পেয়ে খুজতে খুজতে যখন আমগাছতলায় আসল , তখন
আমগাছের ডালে সিরাজ
মিয়ার ফাসিতে ঝুলানো বিকৃত
লাশটা দেখতে পায় ।
করপোরেট জীবনে ছুটি খুব
একটা পাওয়া যায় না । এবার তিনদিনের
ছুটি পাওয়াতে বন্ধু অরুণের
সাথে বেড়াতে চলে এলাম
মধুপুরে । মধুপুর
গ্রামটি সত্যিই সুন্দর । অরুণ
যতটুকু বলেছিল তার চেয়েও বেশী । সে এ গ্রামেই
জন্মেছে । পৃথিবীতে কিছু
স্বপ্নাবিষ্ট মানুষ জন্মায়
যারা কখনো তাদের
শিকড়কে অস্বীকার করে না ।
অরুণ তাদেরই দলে । তার কাছে এ গ্রামের
কথা এতো শুনেছি যে ,
এখানে এসে মনে হচ্ছে মধুপুরকে আমি অরুণের
চেয়েও ভাল চিনি ।
ট্রেন থেকে নেমেছি সেই
দুপুরবেলা । এখন গরু গাড়িতে করে চলেছি অরুণদের
বাড়িতে ।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়
গরুর গাড়িতে চড়া খুবই
আরামের । কিন্তু গরু
গাড়ি যে এতঝাকি খায় , না চড়লে বুঝা যায়না । তীব্র
ঝাকিতে আমার মাথাব্যথা শুরু
হয়েছে । অরুণ আমার
পাশে বসে একনাগাড়ে কথা বলেই
যাচ্ছে । শেষে বিরক্ত
হয়ে বললাম --কি রে ? আর কত দূর?
--এইতো দোস্ত , এসে পড়েছি ।
আর আধঘন্টাখানেক ।
-- আরও আধঘন্টা ! প্রচুর
ক্ষুধা লাগছে রে । এখন
কি করি ? -- চিন্তা করিস
না,বাড়িতে ফোন
কইরা দিছি । সব
রান্না রেডী ।
খাইয়া খাইয়া পেট বানাইছস
বটে একখান ! দোস্ত এখন থেকে একটু কম খাওয়া শুরু কর ।
ডায়েট করা শুরু কর ।
--এত কথা বলিস না । এখন চুপ
কর , মাথা ব্যথা করছে।
বিকেলের আগেই পৌছে গেলাম
অরুণদের বাড়িতে । অরুণের চাচা রহিম উদ্দিন আগেই
দাড়িয়ে ছিলেন রাস্তায়
এসে । গাড়ি থেকে নেমেই
চাচাকে সালাম দিলাম,
চাচা হাসি মুখে বললেন,
--এতক্ষণে আইলা তোমরা । --আর বইলেন না চাচা ,
গরুরগাড়িতে চড়ে মাথা ব্যাথা করতাছে ।
--নতুন উঠলে একটু আধটু
মাথা ব্যথা করেই । লও লও
ভিতরে লও।
অরুণদের বাড়িটা সুন্দর । শুধু সুন্দরই না,সজানোও বটে ।
উঠোনের এক কোণায় ফুলের
বাগান , ফুল
ফুটে আছে সেখানে । আর এতেই
এ বাড়ির সৌন্দর্য
বেড়ে গেছে বহুগুণে । কিছু অচেনা ফুলের
গন্ধে বাড়ি ভরে গেছে ।
আমি বললাম ,
-- এটা কি ফুলের গন্ধরে?
--কি জানি । চল আগে হাতমুখ
ধুয়ে আসি । বাড়ির পাশেই বিরাট পুকুর ।
আমরা পুকুর থেকেহাতমুখ
ধুয়ে খেতে বসে গেলাম ।
খাওয়া শেষে অরুণআমায়
ঘুরতে নিয়ে বের হল ।
রাত তখন দশটা । হারিকেনের আলোয় অরুণ আর
আমি বিছানা ঝাড়ু
দিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করছি ।
অরুণ হঠাৎ বলল
--সকালে আমার আবার ফজরর
নামাজ পড়ার অভ্যাস আছে , তুই পড়বি নাকি ?
--আমার যা ঘুম । হাতি দিয়েও
টেনে তুলতে পারবি কিনা সন্দেহ
। ডাক
দিয়ে তুলতে পারলে যাব ,ডাকিস
। দুজনে শুয়ে কথা বলতে বলতে কখন
যে ঘুমিয়ে গেছিজানিনা । ঘুম
ভাঙল অরুণের ডাকে ।
--দোস্ত উঠ ,উঠ । সকাল
হয়েগেছে । নয়টা বাজে । উঠ
। বিছানায় উঠে দেখি সকাল
হয়ে গেছে । রোদের আলোয়
ঝলমল করছে চারপাশে । অরুণ
গম্ভীর
মুখে দাড়িয়ে আছে বিছানার
পাশে ,বলল --আজকেই ঢাকা চলে যাব । উঠ
। রেডি হয়ে নে ।
আমি অবাক হয়ে বললাম
--কিরে কি হয়েছে ?
এসেছি তিনদিন থাকব বলে ।
আর তুই আজই চলে যাবি ? কিছু কি হয়েছে?
-- না কিছু হয়নি । এখন
রেডি হয়ে নে । দুপুরের ট্রেন
ধরতে হবে ।
আমি অবাক হয়ে অরুণের
দিকে তাকিয়ে রইলাম । ভাবলাম হয়তো অরুণের
সাথে তার চাচা বা চাচীর
ঝগড়া হয়েছে ।
কথা না বাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে সোজা পুকুর
পাড়ে চলে এলাম । হাত মুখ
ধুয়ে পুকুর থেকে উঠেই দেখি অরুণের চাচা দাড়িয়ে
--তোমরা না কি আজই
চইলা যাইতাছ ?
--অরুণতো তাই বলল ।
আচ্ছাচাচা কি হয়েছে যে অরুণ
চলে যেতে চাচ্ছে ? --কি জানি । বুঝবার পারলাম
না । তুমি মনে কিছু লইও না ,
ও একটু এমনই । তয়
পরে আরেকবার সময় কইরা আইস
।
।। সেদিন বিকালের ট্রেনেই
আমরা ঢাকায় রওনা দিলাম ।
অরুণ সকাল থেকেই গম্ভীর
হয়ে আছে । আমার সাথে তেমন
একটা কথা বলছে না ।
অরুণকে আমি সবসময়ই হাসিখুশি থাকতে দেখেছি ।
এমন গম্ভীর মুখে তাকে কখনোই
দেখিনি । আমি শতবার
তাকে জিজ্ঞেস করেছি --
কিরে কি হয়েছে ? একবারও
সে উত্তর দেয়নি । রাত তখন আটটা কি নয়টা ।
অরুণ আর
আমি ট্রেনে সামনাসামনি বসে আছি ।
ট্রেনের এ
কামরাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন
। ট্রেনের সকল বাতি নিভানো হয়েছে অনেক
আগেই । পাশের
জানালাটা খোলা ।
খোলা জনালা দিয়ে হুহু
করে বাতাস আসছে ।
চাঁদেরআলো খানিকটা এসে পড়েছে অরুণের মুখে । আর এতেই
আমি তাকে আবছাভাবে দেখছি ।
এ অদ্ভূত পরিবেশে হঠাৎ অরুণ
আমার দিকে ফিরে আচমকা বলল
--আচছা,শহিদ, তুই কি আত্নায়
বিশ্বাস করিস? আলো ছায়াময় সেই নির্জন
ট্রেনের কামরায় এমন
একটা প্রশ্ন
শুনে আমি শিউরে উঠলেও বলি
-- না । আমি বিশ্বাস
করিনা । হঠাৎ এ প্রশ্ন করলি যে ।
অরুণ কিছুক্ষন চুপ করে কি যেন
ভাবল , তারপর বলতেলাগল,
-- তাহলে শোন ,
তোকে একটা ঘটনা বলি ,অনেকদিন
আগে মধুপুরে দুইজন মানুষ মারা যায় ।
একজনকে মসজিদের পাশের
আমগাছটায়ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়
। এর একমাস পরেই আরেকজন
সেই একই
গাছে আত্নহত্যা করে । গ্রামাঞ্চলে এইসব
ঘটনা নিয়ে খুব তোলপাড় হয় ।
তখন থেকে আমগাছটা সবাই
এড়িয়ে চলতে শুরু করে ।
পারতপক্ষে কেউ রাতে ভুলেও
আমগাছটার তলা দিয়ে যায়না । গতকাল
রাতেফজরের নামাজ পড়তে এই
আমগাছটার তলা দিয়েই
যাচ্ছিলাম । তখনো অন্ধকার
কাটেনি । চাঁদের
আলো হয়তো ছিল । কিন্তু আমি যখন যাচ্ছি তখন ঘোর
অন্ধকার । এমনিতে আমি বেশ
সাহসী । কিন্তু আমগাছটার
তলা দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম ,
তখন খেয়াল করলাম
আমি আসলে ভয় পাচ্ছি , সম্পূর্ণ বিনা কারণে ভয় । নির্জন
একটা রাস্তা দিয়ে একা গেলে যে কেউ
ভয় পেতে পারে । কিন্তু
আমারভয়টা সম্পূর্ণ অন্যরকম ।
আমার মনে হল ঠিক আমগাছের
গোড়ায় কিছু একটা দাড়িয়ে আছে ।
আমি কিছু দেখিনি , তবুও
মনে হল কিছু একটা আমার
দিকে তাকিয়ে আছে । তার
অস্তিত্ত্ব নেই , শরীর নেই ,
কিছু নেই , তবুও মনে হইল কিছু একটা আমার পাশেঠিকই আছে ।
ঠিক তখনি,অন্ধকারে দেখলাম
ঠিক মানুষ বলা যায়না , তবুও
অনেকটা মানুষের মত অবয়ব
ঠিক আমগাছের গোড়ায়
দাড়িয়ে আছে । তখন এক জান্তব ভয় আমাকে গ্রাস করল
। এমন তীব্র ভয়
আমি জীবনে কখনো পাইনি ।
তখন আমি খেয়াল করলাম আমার
পাকাঁপছে । আমি এক চিৎকার
দিয়ে মসজিদের বারান্দায়এসে অজ্ঞান
হয়ে যাই । তারপর কি হয়
জানিনা । জ্ঞান
ফিরলে দেখি মসজিদের
বারান্দায় শুয়েআছি । অনেক
মানুষ ভীড় করে আছে । একনিশ্বাসে কথাগুলো বলেঅরুণ
হাপাতে লাগল । আমি প্রচন্ড
ভয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছি ।
সেদিন ট্রেনে অরুণের
সাথে আর কোন কথা হয়নি ।
অরুণ সারা পথই কি যেন ভাবছিল । রাত তিনটায়যখন
ট্রেনটা ঢাকায় আসে তখন
ট্রেন থেকে নেমে অরুণ শুধু
বলেছিল - যাই ।
পরে দেখা হবে ।
অরুণ থাকে মগবাজারে , তার বাবা মাকে নিয়ে । আর
আমি থাকি মালিবাগে ,
একা একটা ছোট ফ্ল্যাট
ভাড়া করে । বাসায়
ফিরে সেদিন আর
ভয়ে ঘুমুতে পারিনি । বই পড়ে ,
আলো জ্বালিয়ে রাতটা কোনমতে পার
করেছিলাম ।
কিছুদিন পর প্রচন্ড কাজের
চাপে অরুণের গল্প ভুলেই
গেছিলাম । মধুপুরে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ অরুণ
আমাকে ফোন করে উদভ্রান্তের
মত বলল
-- দোস্ত তুই আমারে বাঁচা
-- কেন কি হয়েছে ?
--আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ।
--কি হয়েছে । খুলে বল ।
--সেদিন গভীর রাতে মধুপুর
থেকে ফিরে , ট্রেন স্টেশন
থেকেই
একটা রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম ।
রিকশাটা চলতে চলতে যখন
একটা অন্ধকার গলিতে ঢুকল ,
ঠিক তখনি আমার মনে হল কিছু
একটা আমার পাশের
খালি জায়গায় বসে আছে । অনুভূতিটা এতই তীব্র
যে আমি আমার পাশে একঝলক
তাকিয়েও দেখলাম ।
সেখানে কিছুই নেই ।
আমি বুঝতে পারলাম এটা আমার
মনের ভুল । ঠিক তখনই আমার মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আসল ,
ভয়ানক কোনকিছু মধুপুর
থেকে আমি আমার
সাথে করে নিয়ে আসিনি তো ?
মন থেকে যতই
চিন্তাটা ফেলে দিতে চাইলাম ততই তা ঝাকিয়ে বসল । কিন্তু
রিকশা ভাড়ামিটিয়ে যখনই
আমাদের বাড়ির
গলিটাতে ঢুকলাম তখনই
ঐটাকে দেখলাম । সামনেই
অন্ধকারে দাড়িয়েআছে । তার চোখ নেই ,মুখ নই, পা নেই , তবু
মনে হল
ওটা চেয়ে আছে আমারই দিকে,
তার মুখে ক্রুর হাসি ।।
আমি দৌড়ে বাড়ির
গেটে যেয়ে দারোয়ানকে ডাকতে থাকি । দারোয়ান
আমাকে ধরে নিয়ে পৌছে দিয়ে আসে আমাদের
ফ্ল্যাটে ।
এতকথা অরুণ
একনাগাড়ে বলে হাপাতে লাগল
। আমি বললাম --এ সবই তোর কল্পনা ।
চিকিৎসা নিলে মনে হয়
ঠিকহয়ে যাবে ।
--প্রথমে আমিও তাই
ভেবেছিলাম । তিনজন
সাইকোলজিস্টের সাথে দেখা করেছি , সব
বলেছি, কিন্তু তারা কিছুই
করতে পারেনি । এখন
আমি আমার রুমে তাকে দেখি ,
দেখি কিছু একটা হাটছে আমার
অন্ধকার ঘরে । -ঘর অন্ধকার করে ঘুমালে প্রায়ই
দেখি মশারির ওপাশে কিছু
একটা দাড়িয়ে আছে । তাই
এখন বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাই ।
--ঠিক আছে তোকে আরো কিছু
সাইকিয়াট্রিস্টে র ঠিকানা দিই , তুই
গিয়ে দেখা করে আয় ।
ঠিকানা নিয়ে অরুণ ফোন
রেখে দেয়।
আমার
দেয়া ঠিকানাগুলোতেসে গিয়েছিল কিনা জানিনা । কিন্তু
মাসখানেক পর অরুণ যখন তার
রুমের ফ্যানে ফাঁস
লাগিয়ে আত্নহত্যা করে তখন
খুবই অবাক হই । বহু কাজের
মধ্যেও তার জানাজায় যাই । তার বাবা সেদিন
আমাকে জড়িয়ে কাঁদলেন
অনেকক্ষন। কেন অরুণ
আত্নহত্যা করেছে তা কেউ
বলতে পারেনি । তবে শেষের
দিকেঅরুণ নাকি গভীর রাতে- কে কে বলে চেচিয়ে উঠত আর
একা একা কথা বলত ।
।।
অরুণের লাশ কবর
দিয়ে যখনবাসায় ফিরছি তখন
সন্ধ্যা হয়ে গেছে । অরুণআমার অনেক কালের বন্ধু ।সে আর
আমি একসাথে কত জায়গায়
ঘুরতে গেছি । তারআর আমার
বহু স্মৃতি মনে পড়ে কষ্ট
হতে লাগল । জানিনা কতক্ষণ
উদ্দেশ্যবিহীন হেটেছি , জানিনা কেদেছি কিনা , কত
কি ভেবেছি তাও জানিনা ।
রাত দশটায় বাড়ির
গেটে আসতই দারোয়ান বলল
--ভাইজানের কি মন খারাপ ?
--না । --তাইলে মুখ অমন শুকনা কে?
আমি ঊত্তর না দিয়ে গেট
দিয়ে ঢুকে পড়লাম ।
সিড়ি দিয়ে উঠার সময় পাশের
বাসার বিড়ালটাও
উঠতে লাগল আমার সাথে । আমার ফ্ল্যাট তিনতলায় ।
ফ্ল্যাটের
দরজা খুলে ভিতরে তাকাতেই
এক তীব্র ভয় আমাকে আচ্ছন্ন
করে ফেলল । আমার রুম তখন
পুরো অন্ধকারে ডুবে আছে, পাশের বাড়ি থেকে কিছু
আলো এসে পড়েছে আমার রুমে।
আর এই অস্পষ্ট অদ্ভূত
আলোতে আমি স্পষ্ট দেখলাম
আমার শোয়ার ঘরের
সিলিং ফ্যানটায় ঝুলে আছে অরুণের লাশ ! তীব্র
ভয়ে কাপতে কাপতে দৌড়ে নিচে নেমে ,গেটের
কাছে এসে হাপাতে লাগলাম ।
দারোয়ান দৌড়ে এসে বলল --
আরে ভাইজান কি হইছে?
--লাশ! -- লাশ ? কোথায় ?
--আমার রুমে
দারোয়ান পানি দিয়ে বলল
-- লন পানি খান । আর
কি হইছে একটু খুইলা কন ।
--রুমের দরজা খুলে তাকিয়ে দেখি ,
সামনের
রুমে যে ফ্যানটা তাতে রশি পেচিয়ে কেউ
একজন ঝুলে আছে ।
--কন কি? চলেন তো আমার
সাথে । ফ্ল্যাটে এসে দেখি কিছুই নেই
। দারোয়ান মৃদু
হাসি দিয়ে বলল-- বেহুদাই
ভয় পাইছেন ।
দারোয়ান চলে গেলেও
আমি ফ্ল্যাটে ঢুকতে সাহস পেলাম না । আধ
ঘন্টা পরে যখন ঢুকলাম তখন
আগের ঘটনাটা নিজের কাছেই
কেমন হাস্যকর লাগছে।
রাতে আরেকবার গোসল
সেরে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম ।
গভীর রাতে আমার ঘুম
ভেঙ্গে গেল । আমার ঘুম এত
সহজে ভাঙ্গে না ।
তারমানে কিছু একটা হয়েছে ।
ভালো করে কান পেতে কিছু একটা শুনতে চেষ্টা করলাম
তখন হঠাৎ মনে হল কিছু
একটা নিশব্দে হাটছে আমার
বিছানার চারপাশ দিয়ে ।
মশারির জন্য ভালো করে কিছুই
দেখতে পারছি না তবু মনে হল গাঢ় অন্ধকারেআরো গাঢ় কিছু
একটা নড়াচড়া করছে । তীব্র
একটা ভয় আমাকে গ্রাস করল।
এতো তীব্র ভয়
আমি জীবনে পাইনি ।
ঘরে বাতাসনেই , ফ্যান বন্ধ, তবুও আমি স্পষ্ট দেখলাম ,
আমার মশারিটা হঠাৎ
নড়ে উঠল । হঠাৎ পায়ের
দিকে মশারির দিকে আমার
চোখ গেল , আর তীব্র আতঙ্ক
নিয়ে দেখলাম , সেখানে একজন মানুষের মুখ
দেখা যাচ্ছে ,
অনেকখানি জিভ বের
হয়ে আছে , মুখ রক্তে কালো ,
চোখটা বের
হয়ে আসতে চাচ্ছে বাইরের দিকে । জ্ঞান হারানোর
পূর্বে টের পেলাম মানুষ
পচা তীব্র দুর্গন্ধ আমার
রুমজুড়ে ছড়িয়ে গেছে ।
।।
গভীর রাতে এখনো আমার ঘুমভেঙ্গে যায় ।
তাকিয়ে থাকি অন্ধকারে ।
কিছুই দেখি না । তবু মনে হয়
কিছু একটা তাকিয়ে আছে আমার
দিকে!! ভয়ানক কিছু
একটা হওয়ার প্রতীক্ষায় আমি দিন গুনছি ।
(সংগৃহীত) Ai Golpo Ti Valo Lagle Comment
Kore Please Janaben... Are Apnader Ai Page Are Tune
Golpo Tips And Etc Kamon Lagteche
Ato Please Commete Share
Koiren...? By...Valo Thaken.. Assalamu Aalai Kum... (Posted By...Md...Habibur
Rahman...Habib)